দাম কম, তবু ভালো শেয়ারের ক্রেতা নেই কেন

শেয়ারবাজার নিয়ে একটি প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, শেয়ারের দামই বাজারে বিনিয়োগকারী টেনে আনে; অর্থাৎ শেয়ারের দাম যখন কম থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী হন। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজারে এর উল্টো চিত্রই দেখা যায়। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় থাকলেও বিনিয়োগকারীদের তাতে কোনো আগ্রহই যেন দেখা যাচ্ছে না।

শেয়ারবাজারে কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিওকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগনির্দেশক বলে মনে করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবেও এই সূচক খুব স্বীকৃত। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যে কোম্পানির পিই রেশিও যত কম, সেই কোম্পানি তত বেশি ঝুঁকিমুক্ত। পাশাপাশি এসব কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ ফিরে পেতে সময়ও কম লাগে। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃত শীর্ষ ৩০ কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশেরই পিই রেশিও এখন ১০এর নিচে।

বর্তমানে কিছু ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম খুবই অবমূল্যায়িত পর্যায়ে নেমে এসেছে। এটি সার্বিকভাবে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।...ভালো শেয়ারের প্রতি একধরনের অন্যায্য আচরণ দেখা যাচ্ছে।

শাকিল রিজভী, পরিচালক, ডিএসই

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ভালো কোম্পানি হিসেবে ডিএস৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত ৩০ কোম্পানির মধ্যে অনিরীক্ষিত সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৬টি কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ১০এর কম। তারপরও এসব কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনই কমছে ভালো মানের এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম। তাতে কমছে সূচক। আর দীর্ঘ সময় ধরে ভালো মানের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি অনাগ্রহী করে তুলছে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, যে ১৬ কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ১০এর কম সেগুলো হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি), বিএসআরএম লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, আইডিএলসি ফাইন্যান্স, যমুনা অয়েল, লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট, মবিল যমুনা লুব্রিকেন্টস, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, পদ্মা অয়েল, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মা ও ইউনিক হোটেল। গতকাল রোববার এই ১৬ কোম্পানির মধ্যে ১৫টিরই দরপতন ঘটেছে। বাকি প্রতিষ্ঠান, তথা সিটি ব্যাংকের শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত ছিল। এদিকে ১৬ কোম্পানির মধ্যে আবার ৮টিরই মূল্য আয় অনুপাত ৫এর নিচে। এই ৮ কোম্পানি হলো পূবালী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল, ইস্টার্ন ব্যাংক, বিএসআরএম লিমিটেড ও বিএসসি।

শেয়ারের এত কম দামের পরও বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ দুটি। প্রথমত, বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম আস্থার সংকট রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেসব কোম্পানির পিই রেশিও সবচেয়ে কম, সেগুলোর তথ্যের ওপর বিশ্বাস নেই তাঁদের।

মোহাম্মদ মুসা, শিক্ষক, বাণিজ্য অনুষদ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আলোচ্য ৩০ কোম্পানির মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে কম পিই রেশিও বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের, ২ দশমিক ৯৫। এরপর রয়েছে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি পদ্মা অয়েল, ৩ দশমিক ৩৫। তৃতীয় অবস্থানে আরেক সরকারি কোম্পানি যমুনা অয়েল, যার পিই রেশিও ৩ দশমিক ৫৮। চতুর্থ অবস্থানে বিএসআরএম লিমিটেড, ৩ দশমিক ৮২। পঞ্চম অবস্থানে পূবালী ব্যাংক, রেশিও ৩ দশমিক ৯৪। এ ছাড়া ৪ দশমিক শূন্য ১ পিই রেশিও নিয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম ষষ্ঠ, ৪ দশমিক ৬ পিই রেশিওর সুবাদে বিএসসি সপ্তম এবং ৪ দশমিক ৯৮ পিই রেশিও নিয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ৩এর কম থাকার মানে হচ্ছে, ওই কোম্পানি বর্তমানে যে মুনাফা করছে, সেই মুনাফার ধারা অব্যাহত থাকলে ৩ বছরের মধ্যে ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসবে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঝুঁকি খুবই কম।

একটি কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্যকে নির্দিষ্ট প্রান্তিকের মুনাফা দিয়ে ভাগ করে মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিওর হিসাব করা হয়। শেয়ারের দাম যত কম থাকে আর আয় বা মুনাফা যদি বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে পিই রেশিও কমে যায়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের শেয়ারবাজারে সবচেয়ে ভালো মানের ৩০ কোম্পানির মধ্যে ১৬টির পিই রেশিও একসঙ্গে ১০এর নিচে থাকার ঘটনা খুবই বিরল। পাশাপাশি এটি সামগ্রিক বাজারের জন্য হতাশাজনকও। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এত নিচে নেমে আসার পরও সেগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।

কারণ, সামগ্রিক বাজারের ওপরই বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে শেয়ারের আকর্ষণীয় দামও বাজারে বিনিয়োগকারী টানতে পারছে না।

গত সপ্তাহ শেষে দেখা গেছে, ঢাকার বাজারে সবচেয়ে কম পিই রেশিও হচ্ছে ব্যাংক খাতের শেয়ারগুলোর। এ খাতের তালিকাভুক্ত ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের গড় মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ৫ দশমিক ৪৫। এরপরের অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এই খাতের তালিকাভুক্ত ২৩ কোম্পানির গড় পিই রেশিও বা গড় মূল্য আয় অনুপাত ৫ দশমিক ৬২। কম মূল্য আয় অনুপাতের দিক থেকে এরপরই রয়েছে সেবা ও আবাসন খাত। এই খাতের তালিকাভুক্ত ৪ কোম্পানির গড় পিই রেশিও ৮ দশমিক ৮৮। চতুর্থ অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত ৫৮ কোম্পানির গড় মূল্য আয় অনুপাত ৯ দশমিক ৩৮। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে সিমেন্ট খাত। এ খাতের ৭ কোম্পানির গড় মূল্য আয় অনুপাত ৯ দশমিক ৭৬।

এত কম দাম এবং পিই রেশিও কেন বাজারে বিনিয়োগকারী টানতে পারছে না, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা। তিনি বলেন, শেয়ারের এত কম দামের পরও বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ দুটি। প্রথমত, বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম আস্থার সংকট রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেসব কোম্পানির পিই রেশিও সবচেয়ে কম সেগুলোর তথ্যের ওপর বিশ্বাস নেই বিনিয়োগকারীদের। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর ওপর।

বিনিয়োগকারীদের অনেকে মনে করেন দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফার যে তথ্য দেয়, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। আর্থিক প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলো নিজেদের অবস্থা যতটা ভালো দেখায়, প্রকৃত অবস্থা ততটা ভালো নয়। এ কারণে সবচেয়ে কম পিই রেশিও থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম। একই অবস্থা জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর।

সারা বিশ্বে বিনিয়োগগুরু হিসেবে পরিচিত ওয়ারেন বাফেটের শেয়ারবাজারসংক্রান্ত অনেক পরামর্শের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, কম দামে সাধারণ মানের একটি কোম্পানির শেয়ার কেনার চেয়ে ন্যায্যমূল্যে একটি ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজারে সেই কাজ করার মতো বিনিয়োগকারী এখন খুবই কম। ভালো শেয়ারের দাম কমে গত কয়েক বছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এলেও এসব শেয়ার কেনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ খুবই কম; বরং মাঝেমধ্যে কারসাজি ও সাধারণ মানের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এ কারণে কিছু শেয়ারের দাম বাড়লেও ভালো ভালো শেয়ারের দরপতনে শেয়ারবাজারের সূচকের পতন ঘটছে। কমছে লেনদেন।

জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে কিছু ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম খুবই অবমূল্যায়িত পর্যায়ে নেমে এসেছে। এটি সার্বিকভাবে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। টানা পতনে এখন বিনিয়োগকারীরা বাজারে ছেড়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে ভালোখারাপ কোম্পানি সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। তাঁদের কাছে এখন বিবেচ্য হলো, আরও বেশি লোকসান এড়াতে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া। এ কারণে ভালো শেয়ারের প্রতিও একধরনের অন্যায্য আচরণ দেখা যাচ্ছে।