প্রাদেশিক সরকার বাংলাদেশের জন্য কতটা বাস্তবসম্মত
শুধু
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের যুক্তিতে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা চালুর বিষয়টি গভীর পর্যালোচনার দাবি
রাখে। প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য কতটা যৌক্তিক,
তা নিয়ে লিখেছেন সৈয়দা
লাসনা কবীর, এস কে তৌফিক হক ও মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল
প্রকাশ:
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ০৫
শেয়ার
করুন
সম্প্রতি
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দুই শতাধিক সুপারিশ–সংবলিত একটি প্রতিবেদন দাখিল
করেছে, যেখানে বাংলাদেশে চারটি প্রদেশ গঠনের পাশাপাশি একটি ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ প্রতিষ্ঠার
সুপারিশ করা হয়েছে। এই
প্রস্তাবের পেছনে অন্যতম প্রধান যুক্তি হলো, ঢাকাকেন্দ্রিক ক্রমবর্ধমান
জনসংখ্যার চাপ ও কেন্দ্রীয়
সরকারের সম্প্রসারিত কার্যপরিধির কারণে বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোর কার্যকর সেবা প্রদানে অপ্রতুল
হয়ে পড়া।
বাংলাদেশে
বর্তমানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অত্যন্ত কেন্দ্রনির্ভর। অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড মন্ত্রণালয়
পর্যায়ে কেন্দ্রীভূত, যার ফলে স্থানীয়
পর্যায়ের সমস্যা সমাধানে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। কমিশন
মনে করছে, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন
সম্ভব হতে পারে। এ
ক্ষেত্রে দেশে জনসংখ্যার চাপ
ও সেবার পরিধি বিবেচনায় নিয়ে পুরোনো চারটি
বিভাগকে ভিত্তি করে চারটি প্রদেশ
গঠন করা হলে প্রশাসনিক
কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা
করছে কমিশন।
বিশেষ
করে ঢাকা মহানগরীর ওপর
জনসংখ্যার ভারসাম্যহীন চাপ বাংলাদেশের সামগ্রিক
উন্নয়নকে শহরকেন্দ্রিক করে তুলেছে। জনসংখ্যার
অতিরিক্ত ঘনত্বের ফলে নাগরিক সুবিধা
নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে
পড়েছে এবং বসবাসের অনুপযোগী
পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায়
রাজধানীকে একটি ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’–এর
আওতায় আনার প্রস্তাব করা
হয়েছে। এতে শুধু ঢাকাই
নয়, এর মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী
এলাকা ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন
অঞ্চলের উন্নয়ন সুনিশ্চিত হবে বলে ধারণা
করা হচ্ছে।
প্রাদেশিক
সরকার প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা
জনপ্রশাসন
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব উঠে এসেছে, যা
অনেকের কাছে প্রশংসিত হলেও
এটি বাস্তবায়নের আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ
প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। শুধু উন্নয়ন বা
জনসংখ্যা বিকেন্দ্রীকরণের যুক্তিতে বিশ্বে কোনো দেশ প্রাদেশিক
ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি; বরং দুটি মৌলিক
বৈশিষ্ট্য থাকার পরেই সাধারণত এ
ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
প্রথমত,
প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন হয় তখন, যখন
কোনো দেশের ভৌগোলিক পরিসর এতটাই বিশাল হয় যে কেন্দ্রীয়
সরকারের পক্ষে প্রতিটি অঞ্চলে কার্যকরভাবে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব
হয় না। বৃহৎ ভৌগোলিক
বৈচিত্র্যের কারণে অঞ্চলভেদে নীতি প্রণয়ন ও
বাস্তবায়নে ভিন্নতা প্রয়োজন হয়, যা এককেন্দ্রিক
ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জন করা কঠিন। উদাহরণ
হিসেবে রাশিয়ার কথা বলা যেতে
পারে, যেখানে আয়তনের বিশালত্বের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি প্রতিটি অঞ্চলের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত,
প্রাদেশিক সরকার সাধারণত প্রয়োজন হয় তখন, যখন
কোনো দেশে ভাষাগত ও
জাতিগত বৈচিত্র্য এতটাই প্রকট যে কেন্দ্রীয়ভাবে একক
নীতির আওতায় দেশ পরিচালনা কঠিন
হয়ে পড়ে। ভারতে, রাজ্যসমূহ
সাধারণত ভাষা এবং জাতিসত্তার
ভিত্তিতে গঠিত, যেমন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
ভাষাভাষীদের জন্য, পাঞ্জাব পাঞ্জাবিদের জন্য। একইভাবে, কানাডা, স্পেন বা বেলজিয়ামের মতো
দেশগুলোতে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্যের
কারণে প্রাদেশিক বা ফেডারেল ব্যবস্থা
গৃহীত হয়েছে।
কিন্তু
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য দুটি
অনুপস্থিত। প্রথমত, বাংলাদেশের আয়তন তুলনামূলকভাবে ছোট,
যেখানে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রাদেশিক সরকার
গঠনের উদ্যোগ বাস্তবসম্মত বা প্রয়োজন কি
না, তা নিয়ে যাচাই-বাছাই করার যথেষ্ট কারণ
রয়েছে।
দ্বিতীয়ত,
ভাষা ও জাতিগত দিক
থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত সমজাতীয়, ৯৯% মানুষ একই
ভাষায় কথা বলে এবং
একই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভাষাভিত্তিক বা জাতিগত বিভাজন
নেই, যা পৃথক প্রাদেশিক
শাসন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে।
■ প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের মূল দায়িত্ব ছিল
প্রশাসনকে রাজনৈতিকীকরণের হাত থেকে উদ্ধার
করা ও সিভিল সার্ভিসের
‘কোড অব কন্ডাক্ট’ ঠিক
করা। ■ বাংলাদেশের
আয়তন তুলনামূলকভাবে ছোট, যেখানে প্রশাসনিক
বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রাদেশিক সরকার
গঠনের উদ্যোগ বাস্তবসম্মত বা প্রয়োজন কি
না, তা নিয়ে যাচাই-বাছাই করার যথেষ্ট কারণ
রয়েছে। ■ প্রাদেশিক
শাসনব্যবস্থা চালু করতে হলে
বিদ্যমান সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ পুনর্মূল্যায়ন
করতে হবে, যা প্রশাসনিক
সংস্কার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করবে।
এমন
বাস্তবতায়, শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের
যুক্তিতে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা চালুর বিষয়টি আরও গভীর পর্যালোচনার
দাবি রাখে।
একটি
প্রশ্ন থেকে যায়, প্রদেশভিত্তিক
দেশ বিভাজনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কার্যপরিধির অন্তর্ভুক্ত কি না এবং
এটি কমিশনের মূল লক্ষ্য ও
উদ্দেশ্যের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ,
প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের মূল দায়িত্ব ছিল
প্রশাসনকে রাজনৈতিকীকরণের হাত থেকে উদ্ধার
করা ও সিভিল সার্ভিসের
‘কোড অব কন্ডাক্ট’ ঠিক
করা, যাতে করে প্রশাসনকে
দক্ষ, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করা
যায়। সে ক্ষেত্রে প্রদেশভিত্তিক
প্রশাসন বাস্তবায়িত হলে তা প্রশাসনিক
দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বৃদ্ধির
লক্ষ্যে কীভাবে অবদান রাখবে, তা নিয়ে কিছু
যৌক্তিক প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ থেকে
যায়।
সংস্কার
স্থগিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা
বাংলাদেশে
প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিলে প্রশাসনিক সংস্কার
কমিশনসহ অন্য সব সংস্কার
কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ
তৈরি হবে। দেশের বর্তমান
প্রশাসনিক কাঠামো এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে
গড়ে উঠেছে এবং এখন পর্যন্ত
গঠিত সব সংস্কার কমিশন
এই কাঠামোর জন্য উপযুক্ত সুপারিশ
প্রদান করেছে। ফলে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা
চালু করতে হলে বিদ্যমান
সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ পুনর্মূল্যায়ন
করতে হবে, যা প্রশাসনিক
সংস্কার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করবে।
জাতীয়
নির্বাচন বিলম্বিত করতে পারে
প্রাদেশিক
সরকারব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলতে
পারে। প্রথমত, নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিদ্যমান প্রশাসনিক
কাঠামোর পুনর্গঠন প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন
নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে।
প্রশ্ন উঠবে, কেন্দ্রীয় নির্বাচন আগে হবে, নাকি
প্রাদেশিক নির্বাচন? এই অনিশ্চয়তা নির্বাচনী
ব্যবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয়ত,
প্রদেশগুলোর নামকরণ ও সীমানা নির্ধারণ
বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
দক্ষিণ
এশিয়ায় নিকট অতীতে প্রাদেশিক
ব্যবস্থায় রূপান্তরের অভিজ্ঞতা রয়েছে নেপালের, সেখানে প্রদেশসমূহের সীমানা নির্ধারণ, প্রদেশের নামকরণ ও প্রাদেশিক ব্যবস্থার
বাস্তবায়ন শুরু করতে তিন
বছরেরও অধিক সময় ব্যয়
হয়েছে। বাংলাদেশেও এ নিয়ে যে
দীর্ঘ বিতর্ক তৈরি হবে না,
তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়
না। এতে করে দেশে
রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে,
যা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে
মুখোমুখি করে দিতে পারে।