ব্যাংক খাত তারল্য সংকটে,বাজেট ঘাটতি মেটাতে বেকায়দায় সরকার

প্রবাসী বিনিয়োগ ডেস্ক

জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এর পর দেশের বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত। এতে ঋণের জোগান দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে চলতি (২০২৪-২৫) বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চাপের মুখে পড়েছে সরকার। বিদ্যমান আর্থিক সংকট মোকাবিলায় বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আরও জানা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অর্থ সংকট মোকাবিলায় চলতি সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে ১৪ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ। এতে চলতি অর্থবছরের শুরুতে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সেটি এখন ৯৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৯৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।

এছাড়া একই বৈঠকে চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া বাজেটের আকার ৫৩ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে সংশোধিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এসে বিগত সরকারের নেওয়া অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প বাতিল করেছে। ফলে এখানে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। এছাড়া মেট্রোরেল আগুনে পড়িয়ে দেওয়ার পর এর সংস্কারের জন্য বিগত সরকার বলেছিল ৩০০ কোটি টাকা লাগবে। অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা সেটি ১০ কোটি টাকায় সম্পন্ন করেছেন। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে অপচয় রোধ করে অর্থ সাশ্রয় করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে বাজেটের ব্যয় কমছে। তবে প্রতিবছরই বাজেট কাটছাঁট একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এ বছর প্রকল্পের অর্থ অপচয় রোধের কারণে একটি বড় অংশ সাশ্রয় হবে, যা ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না।

এদিকে সংশোধিত ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৯৯ হাজার কোটি টাকা থেকে গত জুলাই-মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৩ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়েছে। সেখান থেকে ৪১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করায় সরকারের ব্যাংকের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ করেছে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে। এ সময়ে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজস্ব আহরণ কম এবং সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলায় সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, বিগত এক বছরে ব্যাংকগুলোয় আমানতের প্রবৃদ্ধি দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি হয়নি। কিন্তু সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছিল। আমানত থেকে সরকার ব্যাংক ঋণের পুরোটা নিয়ে গেলে বেসরকারি খাতের জন্য কী থাকবে। এতে বেসরকারি খাত ঋণ সংকটে পড়বে। এছাড়া সরকারের শতভাগ অর্থায়নের প্রকল্পের পণ্য আমদানি বাজার থেকে ডলার কিনে করতে হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনাই স্বাভাবিক।

গত জুনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার এক মাস পরই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। ফলে বিগত সরকার বাজেট ঘোষণা করলেও বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে পড়ে। এর মধ্যে দেখা দেয় অর্থনীতিতে নানা সংকটও। বিপর্যয় নেমে আসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদনে। স্থবিরতা দেখা দেয় বন্দরগুলোয়। ধীরগতি নেমে আসে আমদানি-রপ্তানিতে। বন্ধ হয়ে যায় মাঠ পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম। ফলে সবচেয়ে বেশি আঘাত আসে রাজস্ব আহরণে।

সূত্রমতে, অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে দেশের রাজস্ব আয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আট মাসে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এটি বিগত দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম। অথচ রাজস্ব আদায়ের বড় একটি খাত হচ্ছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক।

একই সময়ে ২৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার কাস্টমস ডিউটি আদায় হয়। এটিও বিগত দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম। আর আয়কর আদায়ের অঙ্ক বিগত দুই অর্থবছরের তুলনায় অর্ধেক। ৭৩ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা এ খাত থেকে আদায় হলেও ২০২৩-২৪ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ১ লাখ ২২ হাজার ৯৭৬ কোটি ও ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা আদায় হয়েছিল। শুধু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এ খাতে অর্থ আদায় বড় ধরনের কমেছে।

ঋণ সংকটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সরকার বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে-এমনটি আভাস দিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে প্রবৃদ্ধি অর্জন বাড়ানোর প্রতি তেমন মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। স্বাভাবিক গতিতে প্রবৃদ্ধি যা হবে, সেটি মেনে নেওয়া হবে। ফলে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ কাটছাঁট করে ৫ শতাংশে আনা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ, বর্তমান এ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিরাজ করছে মূল্যস্ফীতির হার।