সিন্ডিকেটের কবলে হজের বিমান, বিপুল টাকা পাচারের শঙ্কা
হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য রহস্যজনক দরপত্র আহ্বানের অভিযোগ উঠেছে।
পছন্দের
প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এয়ারক্রাফট
লিজ নিতে এ ধরনের
দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে বলে
ধারণা করা হচ্ছে। দরপত্রের
দুটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত নিয়েও দেখা
দিয়েছে বিতর্ক।
বিশেষজ্ঞরা
বলেছেন, এ দুই শর্ত
বহাল থাকলে বিমান আগামী হজের আগে উন্মুক্ত
দরপত্রে কোনো এয়ারক্রাফট লিজ
নিতে পারবে না। মূলত, উন্মুক্ত
দরপত্রে বিমান পাওয়া যাচ্ছে না-এমন যুক্তি
দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ডাইরেক্ট
পারচেজ মেথডে পছন্দের কোনো কোম্পানির কাছ
থেকে এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার চেষ্টা
চলছে বলে জানা গেছে।
বিমান
সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে
তিন দফায় দরপত্র আহ্বান
করেও কোনো সাড়া পাওয়া
যায়নি। শনিবার ছিল তৃতীয় দফায়
আহ্বান করা দরপত্রের শেষ
দিন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবারও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান
দর জমা দিলেও শেষ
পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানই রেসপন্সিভ
হতে পারবে না। চতুর্থ দফায়ও
একই শর্তে দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে
বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, প্রতিটি এয়ারক্রাফট লিজ প্রক্রিয়ার সঙ্গে
বিমানে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট
জড়িত থাকে। এ সিন্ডিকেট এমনভাবে
আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে, যাতে কোনো
এয়ারক্রাফট পাওয়া না যায়। এভাবে
সময়ক্ষেপণ করে একপর্যায়ে পছন্দের
কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি
বিমান লিজ নেয়। এর
আগেও এভাবে একাধিকবার বিমান লিজ নেওয়ার অভিযোগ
রয়েছে বিমানের এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
এর আগে ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স
থেকেও দুটি উড়োজাহাজ লিজ
নেওয়ার জন্য বিমান তিন
দফায় দরপত্র আহ্বান করেছিল। ওই দুই এয়ারক্রাফট
লিজে বিমানের বিরুদ্ধে ১২শ কোটি টাকার
মামলা হয়েছে।
বিমান
সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটি
এ বছর নিজস্ব এয়ারক্রাফট
দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা
করবে। এতে বহরের শূন্যতা
পূরণ করতে এবং সাধারণ
ফ্লাইটের শিডিউল ঠিক রাখতে দুটি
এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়েছে। এক বছরের জন্য
এসিএমআই চুক্তিতে (এয়ারক্রাফট, ক্রু, মেনটেইন্যান্স ইন্সুরেন্স) এ দুই এয়ারক্রাফট
লিজ নেওয়া হবে। অর্থাৎ বিমানের
সঙ্গে পাইলট ও কেবিন ক্রুও
থাকবে। এছাড়া বিমানের ইন্সুরেন্সও সংশ্লিষ্ট দরদাতা প্রতিষ্ঠান দেবে। প্রথমে ৬ মাসের জন্য
লিজ নেওয়া হবে। পরে আরও
৬ মাস সময় বাড়ানো
হবে।
জানা
যায়, রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি এতদিন ২০ বছরের পুরোনো
এয়ারক্রাফট লিজ নিয়ে হজ
ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিল। এতে
একদিকে মোটামুটি প্রতিযোগিতামূলক দরদাতা পাওয়া যেত, অপরদিকে লিজ
ভাড়াও কম পড়ত। কিন্তু
রহস্যজনক কারণে এ বছর প্রথমবারের
মতো হজ ফ্লাইট লিজে
এয়ারক্রাফটের বয়সসীমা ১০ বছর নির্ধারণ
করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উড়োজাহাজের
আসন সংখ্যাও ২০০ প্লাস নির্ধারণ
করে দেওয়া হয়েছে। মূলত এ দুটি
শর্তের কারণে তিন দফায় দরপত্র
আহ্বান করেও কোনো এয়ারক্রাফট
পাওয়া যাচ্ছে না।
এভিয়েশন
সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
হলে অন্য বছরের তুলনায়
বিমান ভাড়ায় ব্যয় বাড়বে দ্বিগুণেরও
বেশি। এই সুযোগে অতিরিক্ত
দামে বিমান লিজ নেওয়ায় পুরো
টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা
আরও বলেন, এরকম শর্ত পূরণ
করে উড়োজাহাজ ভাড়া দেওয়ার মতো
দরদাতা বর্তমানে এশিয়ার কোথাও নেই। তাছাড়া ন্যারো
বডির উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে ভাড়া দেওয়ার মতো
২শর বেশি আসনযুক্ত কোনো
এয়ারক্রাফট বিশ্বের কোথাও নেই। সাধারণত বোয়িং
৭৩৭ ম্যাক্স এবং এয়ারবাস ৩২১
মডেলের উড়োজাহাজগুলোয় আসনসংখ্যা ২শর বেশি হয়ে
থাকে। যদিও বোয়িং কোম্পানির
ম্যাক্স সিরিজের উড়োজাহাজগুলোর কারিগরি ত্রুটিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
আর এয়ারবাস ৩২১ মডেলের উড়োজাহাজগুলো
একদমই ব্র্যান্ড নিউ। এ ধরনের
এয়ারক্রাফট ভাড়া নিতে হলে
বিপুল অঙ্কের টাকা গুনতে হবে
বিমানকে।
সংশ্লিষ্ট
একটি সূত্র জানায়, ইউরোপের হাতেগোনা দু-একটি কোম্পানির
কাছে ১০ বছরের পুরোনো
এয়ারক্রাফট থাকলেও তারা বিমানের কাছে
এ মুহূর্তে এসিএমআই চুক্তিতে (এয়ারক্রাফট, ক্রু, মেনটেইন্যান্স ইন্সুরেন্স) লিজ দিতে রাজি
হবে না।
পতিত
শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও এভাবে একটি সিন্ডিকেট বিমানে
উড়োজাহাজ লিজ নিত। এ
চক্রে সাবেক সরকারের মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতাসহ বিমানের প্রকৌশল ও প্ল্যানিং বিভাগের
একাধিক কর্মকর্তা যুক্ত থাকতেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের লিজিং
দরপত্র তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গেও এরকম অনিয়ম-দুর্নীতি
হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে
বর্তমানে তীব্র ডলার সংকট। এ
সংকট নিরসনে সরকার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কৌশল অবলম্বন
করছে। সেখানে বিমানের মতো প্রতিষ্ঠানে উড়োজাহাজ
লিজে অহেতুক ১০ বছরের শর্ত
যুক্ত করে বিপুল অঙ্কের
ডলার পাচার করার বন্দোবস্ত করা
হচ্ছে বলে মনে করেন
সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞদের
মতে, এসিএমআই লিজে বয়সের শর্ত
জুড়ে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও
মালয়েশিয়ায়ও এসিএমআই লিজে বয়সের শর্ত
দেওয়া হয় না। যদিও
তৎকালীন সরকারের সাবেক বিমানমন্ত্রী জিএম কাদের এসিএমআই
লিজে ২০ বছরের বয়সের
শর্ত দিয়েছিলেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও ২০ বছর বয়সের
এয়ারক্রাফট লিজ নিতে পারবে
বলে বিমানকে জানায়। বিশ্বের প্রায় সব দেশে এসসিএমআই
লিজে ২০ থেকে ২৫
বছরের উড়োজাহাজ নিয়ে থাকে। তাছাড়া
ন্যারো বডির উড়োজাহাজে সর্বোচ্চ
আসন হয়ে থাকে ১৫০
থেকে ১৬০টি। সেখানে ন্যারো বডির কথা উল্লেখ
করলেও বিমান দরপত্রে ২শর বেশি সিটের
কথা উল্লেখ করেছে। এতে স্পষ্টই বোঝা
যাচ্ছে, বিশেষ কোনো সংস্থার তৈরি
করা উড়োজাহাজ ভাড়া নিতেই এ
দরপত্র তৈরি করা হয়েছে।
বিমানের
পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক মমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রথম দুই দফায় দরপত্র
আহ্বান করে উড়োজাহাজ পাওয়া
যায়নি। তবে তৃতীয় দফায়
কিছু পরিবর্তন এনে দরপত্র আহ্বান
করা হয়েছে। তৃতীয় দফায় বেশ কয়েকটি
দরদাতা পাওয়া গেছে। আশা করছি, ধারণার
চেয়ে কম দামে বিমান
ভাড়া নেওয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন,
বিমান পরিচালনা পর্ষদ ও বিমানের নির্বাহী
কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়ার দরপত্রের
শর্ত তৈরি করা হয়।
কাজেই কোনো অনিয়ম হওয়ার
আশঙ্কা নেই। এছাড়া পছন্দের
কোনো কোম্পানির কাছ থেকে উড়োজাহাজ
ভাড়া নেওয়ার তথ্য সঠিক নয়।